
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে বহনকারী উড়োজাহাজটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যাচ্ছিল। ফ্লাইট ট্র্যাকার থেকে দেখা গেছে, এ সময় তার উড়োজাহাজটি ফ্রান্সের আকাশসীমা এড়িয়ে গেছে। এটি গ্রিস ও ইতালির ওপর দিয়ে উড়ে গেছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে নেতানিয়াহু নিউইয়র্কে যাচ্ছিলেন।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ২০২৪ সালের নভেম্বরে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
ইতালি, ফ্রান্স, গ্রিসসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সব দেশই আইসিসির সদস্য। তাই আইন অনুযায়ী এই পরোয়ানা কার্যকর করতে তারা বাধ্য। তবে ইসরায়েলের মিত্র হাঙ্গেরি আনুষ্ঠানিকভাবে আইসিসি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
তবে আইসিসির পরোয়ানা জারির পরও ইতালি, ফ্রান্স ও গ্রিস বেশ কয়েকবার নেতানিয়াহুকে তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিল।
পরোয়ানা জারির পর এবারই প্রথম ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সের আকাশসীমা এড়িয়ে গেলেন। গাজায় জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিরোধিতা বাড়ছে। একই সময়ে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য পশ্চিমা মিত্র ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার ফ্লাইট ট্র্যাকারগুলোতে নেতানিয়াহুকে বহনকারী উড়োজাহাজের গতিপথ দেখা যায়। এতে মনে হচ্ছে, উড়োজাহাজটি ফ্রান্স ও স্পেনের আকাশসীমা এড়িয়ে চলেছে।
জেরুজালেম পোস্ট গত সপ্তাহে জানায়, নেতানিয়াহুর ‘উইং অব জায়ন’ উড়োজাহাজটি পরিকল্পিত পথের চেয়ে দীর্ঘ পথ বেছে নেবে। কারণ, ইউরোপীয় দেশগুলো আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি নাও দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল।
জেরুজালেম পোস্ট জানায়, গাজায় হামলার কারণে রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই উড়োজাহাজের পথ পরিবর্তন করা হয়েছে। আরেকটি কারণ হলো, আইসিসির সদস্যদেশগুলো আইনি পদক্ষেপের মুখে থাকা ব্যক্তিদের তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে নাও দিতে পারে।
ইসরায়েলের মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইয়েচিয়েল লিটারের মতে, গ্রেপ্তারের ভয়ে নেতানিয়াহু ফেব্রুয়ারি মাসেও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সময় দীর্ঘ পথ বেছে নিয়েছিলেন।
সেটি ছিল নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর প্রথম বিদেশ সফর। গাজায় ক্ষুধাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগে তাঁর এবং তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আইসিসি।
অবশ্য সেই সময়ও নেতানিয়াহু ফ্রান্স, ইতালি ও গ্রিসের ওপর দিয়ে গিয়েছিলেন। তখন এই তিন দেশ প্রকাশ্যে জানায়, তারা পরোয়ানা কার্যকর করবে না। তারা যুক্তি দেখিয়েছিল, সরকারপ্রধান হিসেবে নেতানিয়াহু দায়মুক্তি পেতে পারেন।
লিটার গত মার্চে এক ওয়েবিনারে জানান, নেতানিয়াহুর সম্প্রতি প্রোস্টেট অপসারণের অস্ত্রোপচার হয়েছিল। তাই আশঙ্কা ছিল, জরুরি চিকিৎসার জন্য তার উড়োজাহাজকে অবতরণ করতে হতে পারে।
লিটার আরও বলেন, ‘যদি নেতানিয়াহুকে ইউরোপের কোথাও নামতে হতো, তাহলে তিনি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তার হতে পারতেন। তাই তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাঘাঁটির ওপর দিয়ে উড়তে হয়েছিল।’
এপ্রিলে নেতানিয়াহু হাঙ্গেরি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সময় ফ্রান্স, ইতালি ও ক্রোয়েশিয়ার ওপর দিয়ে উড়ে যান।
নেতানিয়াহুকে আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সমালোচনা করেছেন আইনবিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এটি আইসিসির প্রতিষ্ঠাতা চুক্তি ‘রোম সংবিধি’-এর লঙ্ঘন।
গত এপ্রিলে ফ্রান্সের এক কূটনীতিক মিডল ইস্ট আইকে বলেন, নেতানিয়াহুকে বহনকারী ২ ফেব্রুয়ারির ফ্লাইটটিকে ফ্রান্সের আকাশসীমা ব্যবহারের ‘অনুমোদন’ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মতে, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে এটি ফ্রান্সের অধিকার ও বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল।
তবে জাতিসংঘের বিশেষ দূত বেন সাউল ফ্রান্সের এই অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি তখন বলেন, ‘১৯৬৩ সালের টোকিও সনদ অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র সাধারণত উড়ন্ত উড়োজাহাজে হস্তক্ষেপ করে ফৌজদারি আইন প্রয়োগ করতে পারে না।’
তবে এই চুক্তিতে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তির বাধ্যবাধকতা মানার জন্য আইন প্রয়োগ জরুরি হলে সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে।
সাউল যুক্তি দেন, ‘রোম সংবিধি’ তেমনই একটি চুক্তি। এর অধীনে কোনো রাষ্ট্র তার আকাশসীমার ওপর দিয়ে যাওয়া উড়োজাহাজকে অবতরণে বাধ্য করতে পারে, যাতে উড়োজাহাজে থাকা কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা যায়।’
Post a Comment