বিশিষ্টজনদের বিদায়ে রাষ্ট্রীয় নীরবতা ও নির্বাচিত শোক

 

রাষ্ট্রের কাছে শোক প্রকাশ কি শুধু সৌজন্য, নাকি নৈতিক দায়িত্ব? বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যু এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বেছে বেছে শোক প্রকাশ–এ প্রশ্নকে আরও প্রকট করেছে।


বিশিষ্টজনদের বিদায়ে রাষ্ট্রীয় নীরবতা ও নির্বাচিত শোক

অবশেষে বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস শোকবার্তা দিয়েছেন। দেওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি আমৃত্যু রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন; রাজনৈতিক অঙ্গনে খুব একটা কিছু করতে না পারলেও রাজনীতিকে সোজা পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করেছেন। রাজনীতির বাইবে আরও সব ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। শুধুমাত্র ভাষা আন্দোলন নিয়ে যে গবেষণা করেছেন, এরপর আগে-পরে আর কিছু না করলেও তাকে চিরকাল স্মরণে রাখতে হতো আমাদের। তিনি নিজেও একজন ভাষাসংগ্রামী।

তবু ‘অবশেষে’ বললাম এই জন্য যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শোক প্রকাশে যথেষ্ট বাছবিচারী। এটা প্রথম আমার নজরে এল, কিছুদিন আগে পরপর দুদিনে দুজন বড় মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারীনেত্রী, সমাজসেবী ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাহফুজা খানম এবং চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত লেখক অধ্যাপক যতীন সরকারের মৃত্যুর পর। আমি অপেক্ষা করলাম সরকার প্রধান তাদের নিয়ে কোনো শোক প্রকাশ করেন কিনা। শেষপর্যন্ত দেখলাম করেননি। এরপর মারা গেলেন সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার। ধরে নেওয়া যায়, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। যদি আত্মহত্যাও করে থাকেন, এটা একটি কাঠামোগত হত্যা। রাষ্ট্র ও সমাজ এই মৃত্যুর দায় উপেক্ষা করতে পারে না। যতদূর মনে পড়ে বিবিসি বাংলা যোগাযোগ করে বিভুরঞ্জনের মৃত্যু নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে কোনো বক্তব্য পায়নি বলে পড়েছিলাম।

তবে বদরুদ্দীন উমরকে “মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলন সংগ্রামের অন্যতম অগ্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী” হিসেবে বর্ণনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তার মৃত্যু “জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।”

দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত বদরুদ্দীন উমর ৭ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। যথেষ্ট পরিণত বয়সে মারা গেলেও কোনো কোনো মৃত্যুর ক্ষতি পূরণ হয় না। বদরুদ্দীন উমর সেই মানুষদের একজন।

২০২৪ সালের ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের থেকে আজ পর্যন্ত শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক থেকে শুরু করে অনেক গুণীজনকে হারিয়েছে দেশ। তারা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন আজীবন। বাংলা ভাষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলো ছড়িয়ে গেছেন জীবনভর, নিজ কর্ম-গুণে ছিলেন অনন্য। তাদের কয়েকজন— প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ওস্তাদ মিহির লালা, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সুজেয় শ্যাম, ওস্তাদ আশীষ খাঁ, সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিন, বাংলা একাডেমির সাবেক সভাপতি ও মহাপরিচালক, গবেষক ও অনুবাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন-উর রশিদ, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সন্‌জীদা খাতুন, গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর, সুরকার ও গীতিকার সনজিত আচার্য্য, সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার, কবি হেলাল হাফিজ, চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান।

পুরোনো খবর খুঁজে দেখেছি এই মানুষগুলোর কারোর জন্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক প্রকাশ করা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের কাউকে কোনো শোকবার্তা দিতে দেখা যায়নি। একমাত্র সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুর পর মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের একটি শোকবার্তা দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত বদরুদ্দীন উমর ৭ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। যথেষ্ট পরিণত বয়সে মারা গেলেও কোনো কোনো মৃত্যুর ক্ষতি পূরণ হয় না। বদরুদ্দীন উমর সেই মানুষদের একজন।

২০২৪ সালের ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের থেকে আজ পর্যন্ত শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক থেকে শুরু করে অনেক গুণীজনকে হারিয়েছে দেশ। তারা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন আজীবন। বাংলা ভাষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলো ছড়িয়ে গেছেন জীবনভর, নিজ কর্ম-গুণে ছিলেন অনন্য। তাদের কয়েকজন— প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ওস্তাদ মিহির লালা, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সুজেয় শ্যাম, ওস্তাদ আশীষ খাঁ, সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিন, বাংলা একাডেমির সাবেক সভাপতি ও মহাপরিচালক, গবেষক ও অনুবাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন-উর রশিদ, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সন্‌জীদা খাতুন, গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর, সুরকার ও গীতিকার সনজিত আচার্য্য, সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার, কবি হেলাল হাফিজ, চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান।

পুরোনো খবর খুঁজে দেখেছি এই মানুষগুলোর কারোর জন্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক প্রকাশ করা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের কাউকে কোনো শোকবার্তা দিতে দেখা যায়নি। একমাত্র সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুর পর মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের একটি শোকবার্তা দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় আক্রান্ত বদরুদ্দীন উমর ৭ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। যথেষ্ট পরিণত বয়সে মারা গেলেও কোনো কোনো মৃত্যুর ক্ষতি পূরণ হয় না। বদরুদ্দীন উমর সেই মানুষদের একজন।

২০২৪ সালের ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের থেকে আজ পর্যন্ত শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক থেকে শুরু করে অনেক গুণীজনকে হারিয়েছে দেশ। তারা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন আজীবন। বাংলা ভাষা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলো ছড়িয়ে গেছেন জীবনভর, নিজ কর্ম-গুণে ছিলেন অনন্য। তাদের কয়েকজন— প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ওস্তাদ মিহির লালা, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সুজেয় শ্যাম, ওস্তাদ আশীষ খাঁ, সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিন, বাংলা একাডেমির সাবেক সভাপতি ও মহাপরিচালক, গবেষক ও অনুবাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন-উর রশিদ, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সন্‌জীদা খাতুন, গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর, সুরকার ও গীতিকার সনজিত আচার্য্য, সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ার, কবি হেলাল হাফিজ, চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান।

পুরোনো খবর খুঁজে দেখেছি এই মানুষগুলোর কারোর জন্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক প্রকাশ করা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের কাউকে কোনো শোকবার্তা দিতে দেখা যায়নি। একমাত্র সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুর পর মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদের একটি শোকবার্তা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশে বিশিষ্টজনদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোকপ্রকাশের রীতি দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত। এটি কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নয়, বরং রাষ্ট্রের সৌজন্য ও শালীনতার অংশ হিসেবে গড়ে ওঠা এক অনানুষ্ঠানিক প্রথা। স্বাধীনতা পদক বা একুশে পদকপ্রাপ্ত, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কিংবা কীর্তিমান কবি-লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মৃত্যুর পর সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের শোকবার্তা জানানোর বিষয়টি জনগণের কাছে একধরনের নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে ধরা হয়।

তবে বাস্তবতা হলো—এই শোকপ্রকাশ সবসময় সমানভাবে বা নিরপেক্ষভাবে করা হয় না। অতীতে, সেই ১৯৯১ সাল থেকে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা সরকারের আমলগুলোতে দেখে আসছি ভিন্নমতের বিশিষ্টজনদের মৃত্যুর পর প্রায়শই শোকপ্রকাশ করা হয়নি। রাজনৈতিক অবস্থান ও ব্যক্তিগত মতাদর্শের পার্থক্য যেন বেছে বেছে শোকপ্রকাশের ক্ষেত্রে অঘোষিত এক মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে সেই থেকে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রীতিটা বদলাতে পারত। তা হয়নি, বরং বাছাই করার ক্ষেত্রে কে খুশি এবং কে অখুশি হবেন, সেই ভাবনা যেন প্রকট হয়েছে সরকারের মাথায়। ফলে এই চিত্রটা বদলায়নি, বরং আন্দোলনের সব পক্ষকে খুশি রাখতে গিয়ে বেড়েছে। ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর সর্বশেষ বদরুদ্দীন উমর পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনেক মানুষ ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন, যার একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা এর আগেই উল্লেখ করেছি। এটাই বোধ হয় প্রথম অন্তর্বর্তী সরকার কুণ্ঠাহীন চিত্তে শোক প্রকাশ করেছেন। বলে রাখা ভালো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও শোক বার্তা দিয়েছেন। ফলে মুহাম্মদ ইউনূস এবার কুণ্ঠাহীন।

এর আগে যতীন সরকারের মৃত্যু পর্যন্ত বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব প্রয়াত হয়েছেন। এদের মধ্যে কারও ক্ষেত্রে শোকবার্তা দেওয়া হয়নি । বিশেষত, কিছু মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অফ অনারও প্রদান করা হয়নি, যেমন মতিয়া চৌধুরীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে এবং বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তার নাম নেই। শুধুমাত্র ১৪ ডিসেম্বর কবি হেলাল হাফিজের মৃত্যুর পরে সরকারের উপদেষ্টা, সচিব, বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার কর্মকর্তারা এসেছিলেন কবিকে বিদায় জানাতে।

এখানে দৃষ্টিকটূ বিষয়টি হলো—অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রকৃতি ভিন্ন। এটি কোনো দলীয় সরকার নয়, বরং একটি নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশাসন হিসেবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকার কথা। তাই তাদের কাছ থেকে শোকপ্রকাশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রঙের বদলে মানবিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু শোকপ্রকাশের ক্ষেত্রেও বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দিলে, তা সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে সন্দেহ তৈরি করে।

রাষ্ট্রের শোকপ্রকাশ শুধু একটি সৌজন্যবোধ নয়—এটি দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সামাজিক সম্প্রীতিরও প্রতিফলন। ভিন্নমতের হলেও কোনো কীর্তিমান নাগরিকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রের নীরবতা এক ধরনের সাংকেতিক বার্তা দেয়, যা সমাজে বিভাজন ও বঞ্চনার অনুভূতি তৈরি করতে পারে। বেছে বেছে শোকপ্রকাশের এই রীতি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেলেও, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষেত্রে তা কেবল রাজনৈতিক বিতর্ক নয়—নৈতিক প্রশ্নও উত্থাপন করছে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ফেইসবুক পাতায় ২০২৩ সালের ২২ অগাস্ট লিখেছিলেন—“শোক প্রকাশের স্বাধীনতা চাই! কার মৃত্যুতে কে দুঃখিত হবে, এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কার দুঃখে কে দুঃখ পাবে বা কার জন্য কে দোয়া করবে, এটাও একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।”

ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই বক্তব্যের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। শোক আসলে আবেগের বিষয় এবং কে কাকে নিয়ে শোক প্রকাশ করবেন, তা অবশ্যই তার নিজের পছন্দ ও সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু যখন আমরা রাষ্ট্রের কথা বলি—বিশেষ করে রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রিপরিষদ বা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিদের কথা—তখন শোক কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে ওঠে।

রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তির মৃত্যুতে শোক জানালে, সেটি আসলে সেই ব্যক্তির অবদানকে জাতির সামনে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি উপায়। বিশেষ করে যারা স্বাধীনতা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান বা সমাজসেবায় অবদান রেখেছেন—তাদের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক একটি সাংবিধানিক মর্যাদা নয়, কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।

রাষ্ট্রীয় শোকপ্রকাশ সমাজের সব শ্রেণি ও মতাদর্শকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান থাকলেও অবদান ও কৃতিত্বের ক্ষেত্রে আমরা এক কাতারে দাঁড়াতে পারি। এটি বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্যের বার্তা দেয়। রাষ্ট্রীয় শোকের মাধ্যমে ইতিহাসে একটি নির্দিষ্ট বার্তা রেখে যাওয়া হয়—এই ব্যক্তি আমাদের সামাজিক স্মৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝতে পারে, কারা কীর্তিমান ছিলেন এবং কেন তাদের অবদান মূল্যবান। 

শোক শুধু আবেগ নয়, এটি মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্র যখন একজন বিশিষ্ট নাগরিকের মৃত্যুতে শোক জানায়, তখন সেটি প্রমাণ করে যে রাষ্ট্র ক্ষমতার কাঠামোর ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিচ্ছে।

ব্যক্তিগতভাবে কারও মৃত্যুতে শোক না করা বা প্রকাশ না করার স্বাধীনতা অবশ্যই সুরক্ষিত থাকা উচিত। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে আমরা যেমনটা দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আনন্দিত হওয়া, মৃত্যুদিনে শোক করাকে রীতিমতন নাগরিক দায়িত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আসিফ নজরুলদের মতো বহু মানুষ তখন বিরক্ত হয়েছেন, হওয়ারই কথা। কিন্তু এবার উল্টো চিত্র দেখেছি আমরা। রীতিমতন শোক প্রকাশ করতে যারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর পর্যন্ত গিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ মারধরের শিকার হয়েছেন, এক রিকশাচালককে তো রীতিমতন ধরেবেঁধে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ৩২ নম্বরের বাড়িটি তো ৫ অগাস্টের পর বারবার আক্রান্ত হয়েছে, এখন রীতিমতন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এ নিয়ে বরাবরই নীরব। ফলে ১৫ অগাস্টে সরকার প্রধান কোনো শোক প্রকাশ করবেন না, এতে কারোর আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে তিনি ওই দিন খালেদ জিয়ার জন্মদিনে, যে জন্মদিনটি নিয়ে বহুবিতর্ক হয়েছে একসময়, ফুল পাঠিয়ে শুভেচ্ছা পৌঁছে দিয়েছেন। বলাবাহুল্য, কে কাকে শুভেচ্ছা জানাবেন, এটাও তার পছন্দের বিষয়।

যাই হোক, আমরা জন্মদিন নয়, শোক প্রকাশেই সীমাবদ্ধ থাকি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শোকপ্রকাশ ব্যক্তিগত আবেগের বিষয় নয়—এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক সৌজন্য। এখানে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারি মুখপাত্র যে শোকবার্তা দেন, তা পুরো জাতির পক্ষ থেকে একটি স্বীকৃতি, কৃতজ্ঞতা এবং সম্মান বহন করে।

যদি রাষ্ট্র এই দায়িত্ব পালন না করে, বিশেষত রাজনৈতিক মতভেদের কারণে, তাহলে সেটি কেবল ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রয়োগ নয়—বরং রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রের ঘাটতির প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো— ভারত, জাপান, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লেখক, বুদ্ধিজীবী বা অন্যান্য বিশিষ্ট নাগরিকেরা মৃত্যুবরণ করলে সরকার প্রধান শোক প্রকাশ করেন। এর মাধ্যম সাধারণত হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়, সরকারি বিবৃতি বা ভিডিও বার্তার মাধ্যমে, প্রেস সেক্রেটারির মাধ্যমে অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট প্রকাশ করে, এবং কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা (যেমন রাষ্ট্রীয় শোক, পতাকা অর্ধনমিত, রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্য) দেওয়া হয়, নির্ভর করে তার সামাজিক বা রাজনৈতিক গুরুত্বের ওপর।

ব্যক্তিপর্যায়ে শোক ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শোকপ্রকাশ কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ নয়, এটি জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা ও ইতিহাসের প্রতি সম্মান। রাষ্ট্রের নীরবতা অনেক সময় বিভাজনকে গভীর করে, আর রাষ্ট্রীয় শোক আমাদের একত্র করে। তাই শোকপ্রকাশ কেবল ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নয়, রাষ্ট্রেরও নৈতিক ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব।

Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post