পাহাড়ি রক্তে রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন

 

পাহাড়ি রক্তে রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন 

আমরা কি তাহলে মেনে নেব—পাহাড়ের মানুষের জীবন, সম্মান, অধিকার সবই অর্থহীন? রাষ্ট্র কেবল আন্তর্জাতিক মঞ্চে শান্তির বুলি কপচাবে আর দেশের ভেতরে পাহাড়ে রক্ত ঝরবে?



পাহাড়ি রক্তে রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন
মারমা স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি আন্দোলনকারী ও পাহাড়ে বসতি গড়া বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে। খাগড়াছড়ির গুইমারায় ১৪৪ ধারার মধ্যেই সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে একটি বাজারে আগুন দেওয়া হয়েছে।


খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলগত ধর্ষণ, ওই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামা মানুষের ওপর সশস্ত্র হামলা, গুলি চালিয়ে হত্যা—সব মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন এক ভয়াল জনপদে পরিণত হয়েছে। অথচ রাষ্ট্র নির্বিকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তি নির্বাক আর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো চোখ বুজে নীরব দর্শক।

স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরোনো এই বাংলাদেশে পাহাড়ের মানুষ এখনো কি নাগরিক বলে গণ্য হয়? নাকি তারা কেবল রাষ্ট্রের বুকে অবহেলিত এক ভূখণ্ডের অবাঞ্ছিত বাসিন্দা?

আজ জাতীয় রাজনীতিতে অন্য খেলা চলছে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি হবে না, নির্বাচনি সংস্কার কতটুকু হবে, জুলাই ঘোষণাপত্র কোন দল কতটুকু মানবে—এসব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মাথাব্যথার শেষ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাধারণ অধিবেশনে গিয়ে বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন, শান্তি আর মানবাধিকারের বুলি আওড়াচ্ছেন, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও রক্ত ঝরা শুরু হয়ে গেছে।


প্রশ্ন জাগে, পার্বত্য জেলায় কতজন মানুষ নিহত হয়েছে? কেন তাদের ওপর গুলি চালানো হলো? সংবাদমাধ্যম বলছে তিন জন। যতজনই খুন হোক, এই হত্যার নির্দেশ কে দিল? কেন আদিবাসীদের আন্দোলনকে দমন করতে রাষ্ট্র মারণাস্ত্র ব্যবহার করল, লেলিয়ে দিল সেটেলারদের?

এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ দিচ্ছে না। রাষ্ট্র নির্বাক, সরকার যেন থেকেও নেই। পতাকাবাহী গাড়িতে চলাফেরা আর মাঝে মাঝে বিবৃতি ছাড়া তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। অবশেষে ৩০ সেপ্টেম্বর মুখ খুলেই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক মারমা ছাত্রীকে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনার জের ধরে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে ‘ভারতের ইন্ধন’ দেখতে পাওয়ার কথা বলে দিয়েছেন।

ভারত এমন কিছু করতেই পারে না–এমন ধোয়া তুলসী পাতা ভাববার কোনো কারণ নেই। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ভারতের সঙ্গে খাগড়াছড়িকাণ্ডে ‘ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনের’ কথাও বলেছেন। এ যেন ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ বলে দিয়ে নিজেদের দায় মুক্ত করার সেই পুরোনো রীতি।



আমাদের ভুলে যাওয়ার কারণ ঘটেনি যে বিগত সরকার দেড় দশক ধরে যাবতীয়, ঘটন-অঘটনে ‘বিএনপি-জামাতের ইন্ধন’ দেখতে পেত এবং আমাদের তা দেখাতে চাইত। নিজের দায়-দায়িত্ব এড়াবার জন্য ইন্ধনদাতা খুঁজে বের করা কোনো ভালো ফল নিয়ে আসে না।

শুধু সরকার নয়, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোও মুখে তালা মেরে রেখেছে। যেসব দল নির্বাচন, গণতন্ত্র আর জনগণের অধিকার নিয়ে অহর্নিশি চিৎকার করে বেড়ায়, পাহাড়ে রক্ত ঝরলে তারা একেবারেই চুপ। কারণ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভোট নিয়ে, সমর্থন নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারী বাঙালি সেটেলারদের অধিকার নিয়ে দলগুলো যতটা উদ্বিগ্ন, পাহাড়িদের ব্যাপারে ততটাই নীরব! এই নীরবতা আসলে তাদের আসল চরিত্র উন্মোচন করে—মানুষ নয়, ক্ষমতাই তাদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। তাদের বক্তব্যে মানবতার আবেগ থাকলেও আচরণ ও কাজে কেবল ক্ষমতার গ্রাফ উঁচু করার চেষ্টা।

এদিকে রাষ্ট্রের মূলধারার মানুষদের চোখেও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন একপ্রকার অদৃশ্য। তাদের ধর্ষণ, হত্যা, গুম-নির্যাতন যেন স্বাভাবিক, যেন প্রত্যাশিত। মিডিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত বর্বরতা নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই, নেই আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর মানবেতর পরিস্থিতির বিবরণ। অথচ সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে সমান অধিকার দিয়েছে। এই অধিকার কি পাহাড়ি মানুষের জন্য নয়? নাকি রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি কেবল সমতলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্য? যদি এমন হয়, তবে আমাদের সংবিধান, আমাদের আইন, আমাদের রাষ্ট্রীয় চেতনা—সবই শব্দের জাল আর মিথ্যার পোশাকে ঢাকা এক রঙিন নাটক মাত্র।



ধর্ষণ আজ বাংলাদেশে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু পাহাড়ি নারীদের ক্ষেত্রে এর পেছনে আছে বাড়তি নিপীড়নের রাজনীতি। তারা নারী হওয়ার কারণে যেমন শিকার, আদিবাসী হওয়ায় তারা আরও বেশি বিপন্ন। তাদের ওপর ধর্ষণ চালিয়ে কেবল শারীরিক নিপীড়ন নয়, গোটা সম্প্রদায়ের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।

এটি কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অস্ত্র, দমননীতি। যখন একজন পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসে, তখন তা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্তরে ঝটকা দেয়—তাই তার বিরুদ্ধে মুঠোফোন হুমকি, চাপপ্রয়োগ, নীরবীকরণ কিংবা সরাসরি বলপ্রয়োগ চালানো হয়। আর যখন ধর্ষণের প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নামে, তখন তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়—যেন বোঝানো হয়, ‘চুপ করে থাকো, না হলে মরে যাও।’ বার্তাটি স্পষ্ট—অধিকার চাইলে জীবন উৎসর্গ করতে হবে!

রাষ্ট্র যখন পাহাড়ি জনতাকে হত্যার পরও কোনো জবাব দেয় না, অপরাধীদের বিচার করে না, তখন নাগরিকরা কে বাঙালি না পাহাড়ি কে আদিবাসী এই তর্কে লিপ্ত হয়। তারা ভুলে যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বহুকাল ধরে একটি বিশেষ অঞ্চল। ব্রিটিশ শাসনামলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা আইনি মর্যাদা দিয়ে বিশেষভাবে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছিল, যেখানে বাইরের লোকজন জমি কিনতে বা স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে পারত না।

হাজার বছরের ইতিহাস, পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আর মৌখিক ঐতিহ্য প্রমাণ করে পাহাড়ে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বম, খিয়াং, খুমি, লুসাইসহ ডজনখানেক জনগোষ্ঠীই এখানে প্রাচীনকাল থেকে বসতি স্থাপন করে এসেছে। তারা নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, জমির মালিকানা পদ্ধতি, এমনকি রাজনৈতিক কাঠামো—সবকিছু মিলিয়ে আলাদা পরিচয়ের অধিকারী।

কিন্তু দেশভাগের সময় ভৌগোলিকভাবে পূর্ববাংলার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য একটি কৌশলগত অবস্থান হিসেবে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে কোনো আলোচনা ছাড়াই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৭১ সালের পরও পাহাড়ে বাঙালির সংখ্যা ছিল নগণ্য—আনুমানিক মোট জনসংখ্যার মাত্র চার-পাঁচ শতাংশ।

কিন্তু আশির দশক থেকে রাষ্ট্রীয় নীতি বদলাতে শুরু করে। তখন সামরিক সরকার ‘বাঙালি পুনর্বাসন প্রকল্প’ হাতে নেয়, যার মাধ্যমে সমতলের ভূমিহীন বাঙালিদের দলে দলে পাহাড়ে পাঠানো হয়। এই বাঙালি বসতি স্থাপনকারীরা (Settlers) সরকারি সহযোগিতায় পাহাড়ি জমি দখল করতে থাকে। একদিকে ছিল সমতলের দরিদ্র মানুষের জমির চাহিদা, অন্যদিকে পাহাড়ে বিদ্রোহ দমন করার কৌশল। পাহাড়ে যদি ব্যাপকভাবে বাঙালি জনসংখ্যা তৈরি করা যায়, তবে সেখানে আলাদা কোনো আন্দোলন টেকসই হবে না—এমনটাই ছিল শাসকদের ধারণা।

সেই থেকে পাহাড়ের আদিবাসীরা নিজেদের পরিচয় ও জমির নিরাপত্তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে। অন্যদিকে পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারী বাঙালিরাও দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা আর প্রশাসনিক খেলায় বলির পাঁঠা হয়ে আছে। চলছে বিচারহীনতার শাসন।

বিচারহীনতার এই নৈরাজ্য যদি চলতে থাকে তাহলে গোটা সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে, মানুষ হারাবে ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা, হারাবে রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস। যখন আইন নীতিনির্ধারক হয় না, তখন অপরাধীর ক্ষমা সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। না, এটা কোনো সমাধান নয়, এটা আত্মসমর্পণ। আর আত্মসমর্পণ পরাজয়ের শুরুর নাম।

আমরা কি তাহলে মেনে নেব—পাহাড়ের মানুষের জীবন, সম্মান, অধিকার সবই অর্থহীন? আমরা কি মেনে নেব—রাষ্ট্র কেবল নির্বাচনের হিসাব করবে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে শান্তির বুলি কপচাবে, অথচ দেশের ভেতরে পাহাড়ে রক্ত ঝরবে?

না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এই নীরবতা ও দমননীতি আমাদের জাতির নৈতিক ভিত্তি ক্ষয় করে, আমাদের আইনি সংস্কৃতিকে পুড়িয়ে ছাই করে। একে প্রতিরোধ করতে না পারলে আমরা শুধু অপরাধকে বাড়াতে সাহায্য করব না, বরং একটি নতুন ধরনের ঘৃণার সমাজের জন্ম দেব—যেখানে পদক্ষেপহীনতা, ভয়ের রাজনীতি এবং অন্যায়ের সঙ্গে আপসই নৈতিক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে।

আজকের দিনে পাহাড়ি কিশোরীর ধর্ষণ ও পাহাড়ি জনতার ওপর গুলি চালানো—এ দুটি ঘটনা আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতির আসল চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে। এখানে মানুষ নয়, ক্ষমতাই আসল। এখানে ন্যায় নয়, দমনই নিয়ম। এখানে শান্তি নয়, রক্তই ভাষা। আর এই ভাষা যতক্ষণ পর্যন্ত দাঁতে দাঁতে না ফেটে পড়ে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দেশের সম্মান, আইনের শোভা, মানবতাবোধ ক্ষতিগ্রস্তই থাকবে।

রাষ্ট্র যদি সত্যিই দায়িত্বশীল হতো, তবে এ ঘটনায় দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হতো, বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হতো, ভুক্তভোগী পরিবারকে নিরাপত্তা ও সহায়তা দেওয়া হতো, আর আন্দোলনকারীদের ওপর হামলাকারীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হতো। সেখানে পুনর্বাসন, চিকিৎসা, আর্থিক সহায়তা, আইনি সহায়তা—এই সবই নিশ্চিত করা হতো।

কিন্তু আমরা জানি, বাস্তবে এমন কিছু হবে না। হবে কেবল কাগজে-কলমে তদন্ত কমিটি, ফাঁপা বিবৃতি, হয়তো কয়েকজনকে লোকদেখানো কায়দায় গ্রেপ্তার করা হবে, তারপর ধীরে ধীরে সব চাপা পড়ে যাবে। এটাই বাংলাদেশের পরিচিত রীতি, রক্তে লেপ্টে থাকা ইতিহাসের পুরনো ছাপ।



Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post