চাঁদার টাকায় হোটেলে ‘ফুর্তির আয়োজন’

 রাজধানীর উত্তরায় গার্মেন্টস ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে আদায় করা চাঁদার সাড়ে ৫ লাখ টাকা নিয়ে একটি হোটেলে ফুর্তির আয়োজন করেছিলেন সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া সেই ব্যক্তিরা। এজন্য তারা উত্তরায় একটি আবাসিক হোটেলের কক্ষও ভাড়া নিয়েছিলেন। চাঁদার টাকা রেখেছিলেন সে কক্ষেই। তবে ফুর্তি করার আগেই তাদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে উত্তরার ১ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত হোটেল ‘এয়ার ইন’-এর কক্ষ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

গত বৃহস্পতিবার রাতে এ এইচ এম নোমান রেজা, তানজিল হোসেন, ফারিয়া আক্তার তমাসহ কয়েকজন সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনের বাসায় যান। তারা ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে বলে তাকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরে তাদের সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়ে রেহাই পান ওই ব্যবসায়ী। বাকি টাকার জন্য হুমকি দিলে ঘটনার পরদিন উত্তরা-পশ্চিম থানায় চাঁদাবাজির মামলা হয়। দেলোয়ারের স্ত্রীর বড় ভাই রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। সেই মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া আক্তার তমা সম্প্রতি বিএনপি নেতা (তিন মাসের জন্য পদ স্থগিত) ফজলুর রহমানের বাসার সামনে মব সৃষ্টি করে আলোচনায় আসেন। তিনি বিএনপির ওই নেতাকে ঘিরে আপত্তিকর ও অশ্লীল স্লোগান দেন এবং প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।

উত্তরায় ঘটনার শিকার পরিবারটি বলছে, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া গ্রেপ্তার তিনজনসহ অন্তত আটজন বাসার নিচে আসেন। এ সময় কয়েকজন পুলিশ সদস্যও সঙ্গে ছিলেন। তারা ব্যবসায়ী দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করতে বাসায় ঢুকতে চাইলে পরিবারের লোকজন জানান যে, দেলোয়ার বাসায় নেই। তখন পুলিশ চলে গেলেও সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া লোকজন জোর করে বাসায় ঢুকে রাতভর পুরো বাসা তছনছ করেন। ১০ লাখ টাকা চাঁদা না দিলে দেলোয়ারের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেন। শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে সাড়ে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়।

চাঁদাবাজির ঘটনায় মামলার বাদী রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ কালবেলার কাছে সেই রাতের ঘটনার বিবরণ দেন। তিনি বলেন, রাত ১টার দিকে পুলিশ থাকলেও দেলোয়ার বাসায় নেই জেনে পুলিশ চলে যায়। খবর পেয়ে তিনি আশকোনার বাসা থেকে ভগ্নিপতির বাসায় যান। তখন সমন্বয়করা জোর করে বাসায় ঢুকে দেলোয়ারকে খোঁজার নামে পুরো বাসা তছনছ করে। ছাদ পর্যন্ত তল্লাশি চালায়। এতে বাসায় থাকা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাদের আচরণ ছিল ভয়াবহ।

রিয়াজ উদ্দিন বলেন, তল্লাশি করা লোকদের মধ্যে মূলত নোমান রেজা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আরেকটা মেয়ে (ফারিয়া আক্তার তমা) ভিডিও করছিলেন আর গালাগাল করছিলেন। তাদের বলা হয়, দেলোয়ার বাসায় নেই, এজন্য পুলিশ তো চলে গেল। তখন তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। নোমান বলতে থাকেন, ‘আমি নোমান। আমার কথা ছাড়া পুলিশ এ এলাকায় কোনো আসামি ছাড়ে না, ধরেও না।’ তখন তিনি (বাদী) পরিচিত একজন কর্মকর্তাকে ফোন দিতে চাইলে নোমান হুংকার দিয়ে বলেন, ‘যত উপরে যাবেন, যাকেই ফোন দেবেন, কোনো লাভ হবে না।’ ফারিয়া আক্তার তমা বলতে থাকেন, ‘আসামি কীভাবে বের করতে হয়, তা আমরা জানি।’ এটা বলেই মেয়েটা ছাদে চলে যায়। এরপর ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত যাচাই করে। দেলোয়ারকে না পেয়ে তারা ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। ভোর পর্যন্ত দেনদরবার করে তাদের হাতে সাড়ে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়।

ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা-পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক আব্দুল মালেক খান বলেন, মামলা হওয়ার পর পুলিশ দ্রুতই আসামিদের মধ্য থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। প্রথমে নোমান রেজাকে গ্রেপ্তারের পর তানজিল ও তমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ওই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চাঁদাবাজির সাড়ে ৫ লাখ টাকার বড় একটা অংশ এয়ার ইন আবাসিক হোটেলের ৩০৯ নম্বর কক্ষে আছে। এরপর তিন আসামিকে নিয়ে ওই কক্ষ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, হোটেল কক্ষটি নোমান রেজার নামে ভাড়া করা ছিল। ঘটনার পর তারা সেখানে অবস্থানও করে। পুরো ঘটনাটি তদন্তের পাশাপাশি পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

অবশ্য তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নোমান রেজার নেতৃত্বে এ গ্রুপটি চাঁদাবাজির টাকা নিয়ে ফুর্তি করার পরিকল্পনা করেছিল। এজন্য হোটেল কক্ষটি ভাড়া করে। তবে এর আগেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগেও তারা বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার ভয়ভীতি দেখিয়েছিল।

এদিকে ওই তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে দেওয়া পুলিশের আবেদনে বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার তিনজন পেশাদার চাঁদাবাজ বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।

চাঁদাবাজির ঘটনায় মামলার বাদী রিয়াজ উদ্দিন বলেন, পুরো ঘটনায় তার বোনের পরিবার ট্রমার মধ্যে পড়ে যায়। তার ভাগ্নির অবস্থা তো একেবারেই খারাপ। অথচ যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলায় ভগ্নিপতিকে গ্রেপ্তার করতে এসেছিল এবং গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে চাঁদা নিল; সেই সময় দেলোয়ার আন্দোলনকারীদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন। ওই সময় তিনি ট্রাক ভরে আন্দোলনকারী তরুণদের পানি বিতরণ করেছেন। তারাই এখন সেই লোককে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে চাঁদা নেয়!


Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post