শিশুদের ডায়াবেটিস বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে

শিশুদের ডায়াবেটিস বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে


প্রতীকী ছবি

তাসনিমের বয়স মাত্র সাত বছর। এ বয়সেই তার জীবন ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল। হঠাৎ শরীর শুকিয়ে যাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাবের মতো লক্ষণ দেখা দিলে তার বাবার সন্দেহ হয়। পরে এক আত্মীয়ের পরামর্শে তাসনিমের বাবা রোকন উদ্দিন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। পরীক্ষায় ধরা পড়ে, তাসনিম টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।


১৩ বছর বয়সি মাইমুনারও একই অভিজ্ঞতা। ৯ বছর বয়স থেকেই তার শরীরে ইনসুলিন তৈরি হচ্ছে না। মা শিল্পী আক্তার জানান, ঘন ঘন প্রস্রাব, ওজন কমে যাওয়া, অল্পতেই দুর্বল হয়ে পড়ার মতো উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। একদিন হঠাৎ মাইমুনা অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, যেখানে পরীক্ষায় ধরা পড়ে সে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এখন নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হচ্ছে তাকে। শিল্পী আক্তার আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, আমার এবং বাকি চার ছেলেমেয়ে কারো এ রোগ নেই। অল্প বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের তালিকায় রয়েছে আরো অনেক শিশু, যেমন ছয় বছরের রাফসান। তার ক্ষেত্রেও একই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করিয়ে জানা যায়, সে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

চিকিৎসকদের মতে, এ রোগ এখন আর প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই—

শিশুদের মধ্যেও এই রোগ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বেশির ভাগ সময় বাবা-মায়েরাই বুঝতে পারেন না, কখন থেকে তার শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলো। চিকিৎসকরা বদলে যাওয়া জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসকেই এর জন্য দায়ী করছেন।

শিশুদের ডায়াবেটিস : বাস্তব চিত্র

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বারডেম জেনারেল হাসপাতালের মা ও শিশু বিভাগে প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আটজন নতুন শিশু-কিশোর ডায়াবেটিস রোগী আসছে। লাইফ ফর অ্যা চাইল্ড প্রোগ্রাম (এলএফএসি) এবং চেঞ্জিং ডায়াবেটিস ইন চিলড্রেন (সিডিআইসি) কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার কামরুল হুদা আমার দেশকে জানান, উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে শিশু-

কিশোরদের ডায়াবেটিস। বর্তমানে এ হাসপাতালে নিবন্ধিত ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশু-কিশোরের সংখ্যা সাড়ে ৯ হাজারের বেশি। এ হাসপাতালে বিনামূল্যে তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।

কেন শিশুদের মধ্যে ডায়াবেটিস বাড়ছে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা বর্তমানে খেলাধুলা ও কায়িক পরিশ্রমের চেয়ে মোবাইল, টিভি, কম্পিউটারে বেশি সময় কাটাচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে উচ্চ ক্যালরি ও চর্বিযুক্ত খাবার, কোমল পানীয়, ফাস্টফুড এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। এসব কারণে শিশুরা অল্প বয়সেই স্থূলতা ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস আগে ৩০ বছর বয়সের পর দেখা যেত, এখন তা ১৫-১৬ বছর বয়সেও ধরা পড়ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুর মোটা হয়ে যাওয়া, কম শারীরিক পরিশ্রম এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এর মূল কারণ।

টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের পার্থক্য

টাইপ-১ ডায়াবেটিস একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীর স্বাভাবিকভাবে ইনসুলিন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। এতে আক্রান্তদের প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয় বেঁচে থাকার জন্য। এ ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত ছোট বয়সেই ধরা পড়ে।

অন্যদিকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে শরীর ইনসুলিন তৈরি করতে পারলেও তা যথাযথভাবে কাজ করে না। এটি সাধারণত অতিরিক্ত ওজন, শরীরের মেদ বৃদ্ধি ও জীবনধারার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

ঝুঁকিপূর্ণ শিশু কারা?

বারডেম হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সাবরিনা জসীম আমার দেশকে বলেন, টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু সাধারণত দ্রুত শুকিয়ে যায়, অতিরিক্ত প্রস্রাব করে এবং দুর্বলতা অনুভব করে। কখনো কখনো রক্তে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে কিটোসিস হয়, যা জ্ঞান হারানোর মতো জটিলতায় পরিণত হতে পারে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস একটু বেশি বয়সের শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের দেখা যায়। ওজন বেশি, ঘাড়ের চামড়ায় কালো দাগ অথবা কিশোরীদের পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম থাকলে তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য এ রোগ হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন হরমোনের অসামঞ্জস্যতা বা কিছু ওষুধের কারণেও ডায়াবেটিস হতে পারে।

মূল কারণ তিনটি

ডা. সাবরিনা জসীম আরো জানান, শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিসে আক্রান্তের প্রধান কারণ তিনটি। বংশগত, গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস থাকা এবং কম বয়সে ওজন বেড়ে যাওয়া। এছাড়া অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রতি ঝোঁক শিশুদের দৈহিক, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এ কারণে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি বলে ধারণা করা হয়।

বাংলাদেশের চিত্র

ডায়াবেটিস চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে এক কোটি ৩১ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০ থেকে ৮০ বছর বয়সিদের মধ্যে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ এ রোগে ভুগছেন। বিশ্বে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। চলমান হারে বাড়তে থাকলে ২০৪৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দুই কোটি ২৩ লাখে পৌঁছাতে পারে। বিশ্বে প্রতি এক লাখ শিশুর মধ্যে চারজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।

যেসব উপসর্গ দেখে সতর্ক হতে হবে

নিচের এ লক্ষণগুলো দেখা দিলে শিশুর রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করানো উচিত- 

  • অতিরিক্ত প্রস্রাব
  • অতিরিক্ত পিপাসা
  • ওজন কমে যাওয়া
  • দুর্বলতা, ক্লান্তি
  • ঘন ঘন সংক্রমণ
  • ঝাপসা দৃষ্টি
  • শরীরে র‌্যাশ বা কালো ছোপ
  • মাড়ি থেকে রক্তপাত

রুটিন চেকআপ কেন জরুরি?

যেসব শিশুর পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে বা যারা স্থূলকায়, তাদের নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করা উচিত। এতে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ শনাক্ত করে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা

টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয়। এটি ছাড়া এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ইনসুলিন ছাড়াও ১০ বছরের বেশি বয়স হলে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ইনসুলিনও লাগতে পারে। উভয় ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি খাদ্যতালিকা মেনে চলা ও বয়স অনুযায়ী কায়িক পরিশ্রম অপরিহার্য।

প্রতিরোধ কীভাবে?

টাইপ-১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধযোগ্য নয়। তবে নিয়ন্ত্রিত জীবনধারার মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

শেষ কথা

বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুরা যেন অল্প বয়সেই এই রোগে না পড়ে, তার জন্য দরকার সচেতনতা, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও সময়মতো চিকিৎসা। অভিভাবকদেরও তাই সন্তানদের খাদ্যাভ্যাস, দৈহিক সক্রিয়তা ও মানসিক স্বাস্থ্য সব দিক থেকেই আরো যত্নশীল হওয়া জরুরি।

 

Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post